Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

বিডিআর বিদ্রোহের সময় শেখ হাসিনাকে যেভাবে সাহায্য করেছিল ভারত

করেছিল সেনা সমাবেশ, ছিল আরও অনেক প্রস্তুতি

Icon

অভিনাশ পালিওয়াল

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫২ পিএম

বিডিআর বিদ্রোহের সময় শেখ হাসিনাকে যেভাবে সাহায্য করেছিল ভারত

পুরোনো ছবি

২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, বিকেল ৫টা। সেই সময় প্যারাশ্যুট রেজিমেন্টের  ষষ্ট ব্যাটালিয়নের মেজর কমলদীপ সিং সাধু আক্রমণের জন্য অগ্রগামী দলের দায়িত্বে ছিলেন। ঠিক সেই সময়ই আদেশ আসে। সক্রিয় করা হয়েছিল জরুরি সংকেত এবং সম্মুখসারির একাধিক প্যারাট্রুপার দলকে সক্রিয় করা হয়। এক ব্যাটালিয়ান সৈন্যের সক্ষমতা সম্পন্ন স্টাইক ফোর্স ২৪ ঘণ্টা জরুরি মোতায়েনের জন্য সতর্ক ভারত। এই দলটিই ভারতের ক্ষমতার প্রদর্শনের প্রধার বিবেচ্য হয়। 

আগের রাতেই একই ধরনের একটি জরুরি সংকেত সক্রিয় করা হয়েছিল এবং পরে বাতিল হয়। কিন্তু ফের যখন সংকেত সক্রিয় হলো এবং ‘পাঁচ থেকে ছয়টি’ আইএল-৭৬ ও এএন-৩২ বিমান প্রস্তুত রাখার নির্দেশ আসে, সাধু বুঝতে পারেন বড় কিছু ঘটতে চলেছে।

আড়াই ঘণ্টা পর এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় প্যারাট্রুপার নিজেদেরকে পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুণ্ডা বিমানঘাঁটিতে দেখতে পান। সেখানেই রাত কাটাতে সাধুর অধিনায়ক নির্দেশনা দিলেন।

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিডিআর-এর সদস্যরা বিদ্রোহ করেছে। তারা সেনাসদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে হত্যা করছে। সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি আবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন, তিনি নিজেরে জন্য হুমকি মনে করছেন এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের উপর আর নির্ভর করতে পারছেন না।

সেই দিনের কথা স্মরণ করে সাধু বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) ভারতের কাছে সাহায্য চেয়েছেন...এবং সেই জন্যই আমরা বিমানঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছিলাম’, নতুন নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এবং ‘ঢাকায় অবতরণের পর যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।’ নয়াদিল্লি ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। কারণ যদি সহিংসতা বৃদ্ধি পায় তবে এই কূটনীতিকরাও আক্রান্ত হতে পারেন। 

সেই সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার সবচেয়ে নৃশংস ঘটনাটি ঘটছিল।  হত্যাকাণ্ড শুরুর পরপরই হাসিনা তার সবচেয়ে কাছের মিত্র নয়াদিল্লির শীর্ষ কংগ্রেস নেতা, সদ্যই অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রণব মুখার্জিকে ফোন করেন। ঘটনা শোনার পর, মুখার্জি ‘সাড়া দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিলেন। ঢাকা থেকে ‘সাহায্যের অনুরোধের’ পর প্যারাট্রুপারদের প্রস্তুত করা হয় এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন হাসিনার পক্ষে সমর্থন আদায়ে আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান ও চীনা দূতদের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগ শুরু করেন। 

কলাইকুণ্ডার পাশাপাশি জরহাট ও আগরতলাতেও প্যারাট্রুপার প্রস্তুত রাখা হয়। অবস্থা এমন যে, যদি নির্দেশ আসে তবে ভারতীয় সেনারা তিনদিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। 


উদ্দেশ্য ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (পরবর্তীতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামকরণ হয়) ও তেজগাঁও বিমানবন্দর দখলে নেওয়া। পরবর্তীতে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হাসিনাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবে। 

অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেড কমান্ডার যুদ্ধের সময় ব্যবহারের জন্য ‘প্রথম  ধাপের’ গোলাবারুদ বিতরণ শুরু করেন। ‘খুব অস্বাভাবিক’ এই কাজ থেকেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। যদি বাংলাদেশের জেনারেলরা হাসিনার বিরুদ্ধে যান, তারা ভারতীয় সৈন্যদের প্রতিরোধ করবে। সাধু বলেন, ‘যদি সেরকমটা হয়, তাহলে পূর্বভারতে আমাদের পুরো একটি সৈন্যদল আছে,’ শক্তি বাড়াতে সেখান থেকে সেনা পাঠাতে হতো।

২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রায় কাছাকাছিই চলে গিয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত আদেশটি শেষ পর্যন্ত আসেনি। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী তখন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার (২০০৭–১০)। তার পিতৃপুরুষের আদিবাস বাংলাদেশে। হাসিনাকে তিনি সম্মান করে ‘আপা’ বলে ডাকতেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখি এবং হাসিনাকে জানাই তার নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’ কিন্তু কেন? কারণ ভারত ‘জানতো না পরিস্থিতি কতদূর গড়াবে।’

ঢাকায় বিদ্রোহীরা বিডিআর সদরদপ্তর পিলখানায় তাদের মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে। বাংলাদেশ জুড়েই বিভিন্ন স্থানে একইভাবে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উদ্দিন আহমেদের ওপর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকে। কিন্তু তিনি যদি এমন পদক্ষেপ নিতেন তবে তা থেকে একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো এবং অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যেত। একই সঙ্গে তা হাসিনার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলত। বিদ্রোহীদের অথবা বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের হাতে তিনি (হাসিনা) নিহত হতে পারতেন। কিংবা একটি সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত হতে পারতেন। 

২০০৭ সালে তিনি একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। ভারত সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি। তাই দেশটি যা প্রয়োজন মনে করেছে তা-ই করেছে। দেশটি মঈন ইউ আহমেদকে পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য হুমকি দেয়।

তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘যারা ওই সময় ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল তারা আমাকে বলেছিল জেনারেল মইনকে পদক্ষেপ না নিতে বলা হয়েছিল। অন্যথায় [ভারতীয়] প্যারাট্রুপাররা এক ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় নেমে পড়বে।’

সেই সময় ভারতের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ছিলেন, ভারতীয় এমন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ভারত শুধু বলার জন্য তা বলেনি। ‘সেই সবকিছু্ই সত্যি ছিল ... প্রয়োজন হলে আমরা হস্তক্ষেপ করতাম।’

ভারতের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ আসেনি, কারণ জেনারেল মঈন শেষ মুহূর্তে পিছু হটেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ হোসেন ঘোষণা দেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে উদ্ভুত সংকটটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। সমস্যাটির সমাধান সেভাবেই করা হয়েছে।”

ওই সময় বান্দরবানের একটি সেনা ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তার (মঈনের) আসলে আদেশ দেওয়া উচিত ছিল এবং সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল।’

পরবর্তী দুই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা স্থানীয় বিডিআর ইউনিটে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। রহমানের মতে, ‘এটি কোনো রাজনৈতিক ছিল না। একটি সামরিক সংকট হিসেবে সেনাবাহিনীকে নির্ধারিত নিয়মাবলীর মধ্যে থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।’

২০০৯ সালে ভারতের হস্তক্ষেপ উপমহাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দিতো। কিন্তু সেই হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তও ঐতিহাসিকভাবে সমান গুরুত্বপূর্ণ। 

হাসিনাকে রক্ষার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এমন ভোঁতা করে দিল যে তা হাসিনাকে জবাবদিহিতা ছাড়া বা খোলা হাতে প্রতিপক্ষদের প্রতিহত করতে সুযোগ করে দেয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে হাসিনা প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর কোনো প্রকার রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত হলেন —থ্যাংক ইন্ডিয়া।

নয়াদিল্লীর এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে কী কারণ ছিল? ভারতের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানতো। পাশাপাশি, ভারতের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদের যে দূর্নাম, তা আরও পোক্ত হতো। ভারতের হস্তক্ষেপে হাসিনার জীবন বাঁচতো ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে ভারতের ‘আজ্ঞাবহ’ হিসেবে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে, সেটাই প্রমাণ হতো। হাসিনার রাজনৈতিক জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতো। 

ভারত উল্টো দেখলো যে হাসিনা বরং বিডিআর বিদ্রোহটিকে দেখলেন তার সরকারকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত হিসেবে। পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘তিনি নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তবে তিনি এ-ও বুঝতে পেরেছিলেন যে বিদ্রোহকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি স্বজন ও সহকর্মী হারানো বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন।’

ওই সময় সেনা কর্মকর্তাদের হাতে অপমানিত ও হেয় হওয়ার পরেও হাসিনা নিজের অবস্থানে অটল থাকলেন। তিনি তাদের কথা শুনলেন ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেন। তৌহিদ হোসে যুক্তি দেন, ‘তিনি যা করেছিলেন তা  সঠিক ছিল, কারণ এর একটি শান্তিপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল।’ 

বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটলো সেনাবাহিনী যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘তত্ত্বাবধানে’ ট্যাঙ্ক নিয়ে পিলখানায় প্রবেশ করল। প্রায় ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হল। বিদ্রোহের সমাপ্তি ও মইনের সংযম প্রদর্শন হাসিনাকে ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ করে দিল। যেসব কর্মকর্তা হাসিনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন তারা সবাই একে একে চাকরি হারালেন। বিডিআর ভেঙে দেওয়া হল।

স্মৃতিচারণ করে পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘একজন সাহসী, লৌহমানবীর মতো তিনি খুব বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন।’

কিন্তু ভারতকে বাংলাদেশে বলপ্রয়োগ করার মতো সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছিল — এ থেকে মূলত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে ভারতের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। বিডিআর বিদ্রোহের সময় ভারতের এই অনিরাপত্তাবোধের কারণ অনুসন্ধানে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ২০০১-০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত আমল ও ২৬ নভেম্বর মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার সময়কার ঘটনাবলীতে। মুম্বাই হামলার ক্ষত তখনও শুকায়নি। নয়াদিল্লি তাই বিডিআর বিদ্রোহটিকে পাকিস্তান-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং একটি জাতীয় নিরাপত্তাজনিত হুমকি হিসেবে দেখেছিল। বিডিআরের সাধারণ সদস্যদের ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধান ছাড়াও ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এই বিদ্রোহের আদর্শিক পরিকাঠামো নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বিএনপি-জামায়াতের শাসনকালে অনেক জামায়াত-কর্মী বিডিআরের সাধারণ সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল। তাদেরকে দৃশ্যত পাকিস্তান ব্যবহার করেছিল।’

২০০৪–০৭ এর আশা জাগানো সংলাপের পর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর। এমন পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি চায়নি ঢাকায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক কিংবা ভারতবিরোধী কোনো সরকারের উত্থান ঘটুক। যদিও বিডিআর বিদ্রোহ ও বিদ্রোহের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংযোগ প্রচুর গুজবের জন্ম দিয়েছিল, তবে নয়াদিল্লির স্বার্থের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। একদিকে মে মাসে লোকসভা নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশ করছিল। 

ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এই সময়টাতে হাসিনার ক্ষমতা হারানো মেনে নিতে পারতেন না। তাই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিলেন, হাসিনার কিছু হলে জামায়াত ও হরকাত-উল জিহাদ-আল ইসলামী (হুজি-বি) বাংলাদেশ থেকে ভারতে হামলা চালাবে।

এই বিষয়ে বিএনপি সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রসঙ্গ টানা জরুরি। চৌধুরী একজন প্রভাবশালী জাহাজ ব্যবসায়ী ছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরের বাণিজ্য কার্যক্রমে তার প্রবেশাধিকার ছিল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। ১৯৭১ সাল থেকেই তিনি আইএসআই-এর এজেন্ট হিসেবে বিবেচিত হতেন। বিদ্রোহের শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সিএনএন নিউজ নেটওয়ার্কের ভারতীয় শাখা অভিযোগ করে, চৌধুরী পাকিস্তানের পক্ষে বিদ্রোহ উস্কে দিচ্ছেন। ক্রুদ্ধ চৌধুরী চ্যানেলটিকে মামলা করার হুমকি দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন, খালেদা জিয়া হাসিনাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করবেন না। 

বিদ্রোহের এক সপ্তাহ পর ৮ মার্চ তিনি পশ্চিমা কূটনীতিকদের সগৌরবে জানান যে পরিস্থিতি ভুলভাবে মোকাবিলার কারণে জ্যেষ্ঠ ও মধ্যমসারির কর্মকর্তাদের মধ্যে হাসিনার বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। চৌধুরীর মতে এদের অধিকাংশ বিএনপিকে সমর্থন করে। বিদ্রোহকে ঘিরে চৌধুরীর ভূমিকা এবং অনুসন্ধান শুরু হওয়ার আগেই সিএনএন ইন্ডিয়া তাকে দোষারোপ করা একটি জটিল ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়।

বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর, পানি ভাগাভাগি ও অর্থনৈতিক সংযোগের মতো বিষয়গুলিতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলতা তৈরি হয় — চৌধুরীর এতে ভূমিকা ছিল।

২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নির্বাচন জয়ের পর অভিনন্দন জানানো প্রথম বিদেশী গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র। খালেদা সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহ পরে ২৬-২৭ অক্টোবর মিশ্র ঢাকায় যান। কিন্তু এবার দেখা গেল খালেদার ছেলে তারেক রহমান সরকারি ও দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার মায়ের চেয়ে বেশি প্রভাব রাখছেন। তারেকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা মাথুরের (একজন ভারতীয় গোয়েন্দা) মতে, ‘তিনি ভারতের প্রতি আন্তরিক ছিলেন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নয়নের পথে নিজের ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্বকে সামনে আসতে দেননি।’

কিন্তু এতেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেনি। উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহীদের সমর্থন বন্ধ করা এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা — ভারতের এই দু’টি রেড লাইনই বিএনপি আমলে অতিক্রম করা হয়েছিল। মিশ্র ঢাকাকে দিল্লীর এই উদ্বেগগুলো অবহিত করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পরপরই ভোলা ও যশোর জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ শাসক দল বিএনপি ও জামায়াতের আক্রমণের শিকার হন। ঐ অঞ্চলের হিন্দুরা হত্যা ও গণধর্ষণের শিকার হন। তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়, অনেকে বাস্তুচ্যুত হন।

একইভাবে ওই সময়টাতেই উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনে ‘জোয়ার’ দেখা যায়। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল তা প্রকাশ্যে আসে। সেদিন চট্টগ্রামে অস্ত্র ভর্তি দশটি ট্রাক ধরা পড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম অস্ত্র চালানটির গন্তব্য ছিল উত্তর-পূর্ব ভারত। চালান পাঠানোর অভিযান নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ঢাকায় সেফ হাউসে অবস্থানকারী ইউএলএফএ-আই প্রধান পরেশ বড়ুয়া। ওই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র প্রথমে একটি বড় জাহাজ থেকে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ও তারপরে সরকার-অধিকৃত চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ডকে স্থানান্তর করা হয়। 

সেন্ট মার্টিনের জাহাজটির মালিক অন্য কেউ ছিলেন না — ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যিনি ভারতের মতে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছিলেন তারেকের অনুমোদন নিয়ে। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর ভাষ্যমতে, ‘খালেদা জিয়ার ওই অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুত্র অনেক ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল। এরপর অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাতে শুরু করে।’

এর পরপরই মার্কিন সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত ১৪৮টি বিদ্রোহী শিবিরের একটি তালিকা ঢাকাকে সরবরাহ করে। পিনাক রঞ্জন বলেন, ‘তারা আমাদের জবাব দিত যে না, না, আমরা যাচাই করেছি এবং এই শিবিরগুলো সেখানে নেই ... বিষয়টিকে একটা ইঁদুর–বিড়াল খেলায় পরিণত করা হয়েছিল।’

অভিনাশ পালিওয়াল যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক রিডার। ইংরেজি ভাষায় লেখা তার বই ‘ইন্ডিয়া’স নিয়ার ইস্ট: অ্যা নিউ হিস্টোরি’ থেকে নিবন্ধটি স্ক্রল ডটইন প্রকাশ করে। বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি ভাষান্তর করা হলো। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন