Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

শীর্ষ সম্মেলন ছাড়াই সার্কের ১০ বছর

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা কোথায়?

Icon

সেরেনা হুসেন, বিশাল শর্মা ও বীনা সারওয়ার

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৮ পিএম

শীর্ষ সম্মেলন ছাড়াই সার্কের ১০ বছর

২০১৪ সালে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে সার্ক দেশগুলির নেতারা।

ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ভারতে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো জনগণের শক্তি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা-গুরুত্বের একটি অনুস্মারক।

ভারতের নির্বাচন ছিল এই বছর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় নির্বাচনী মহড়া, যার প্রথমটি ছিল জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে। শ্রীলঙ্কায়ও অক্টোবরের আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে।

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে এসব নির্বাচন এমন নেতৃত্ব বেছে আনে যা কেবল সেই দেশ নয়, ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত অঞ্চলগুলোতেও তার প্রভাব থাকে।

সরকারগুলো অন্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে বা বিদেশি শক্তির ইচ্ছা অনুসরণ করতে পারে, বা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা করতে পারে। এসব নির্ভর করছে দেশটির শাসক দলের মতাদর্শ ও কূটণৈতিক দক্ষতার ওপর। সার্কভুক্ত দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে সহযোগিতা করতে পারে, যা তারা বিগত দশকগুলিতে করেছে।

এ অঞ্চলের জনগণের স্বার্থে এ ধরনের সহযোগিতা অপরিহার্য।

কলম্বো সম্মেলন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার গতিপথ শুরু হয়। এই অঞ্চলের সদ্য স্বাধীন দেশগুলো যেমন শ্রীলঙ্কা (তখন সিলন), ভারত ও পাকিস্তান (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানসহ) একসাথে ইন্দোনেশিয়া ও তারপর বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) কলম্বোতে ১৯৫৪ একটি সম্মেলন (২৮ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত) করেছিল।

৭০ বছর আগে আঞ্চলিক সমস্যা মোকাবেলা এবং সহযোগিতার এই প্রাথমিক উদ্যোগ আনুষ্ঠানিক জোটের দিকে আগাতে পারেনি। তবে এটি সেকালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছিল।

স্নায়ুযুদ্ধের বছরগুলোতে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষার সেই প্রচেষ্টার ফলে পরবর্তীতে অভিন্ন উদ্বেগ ও স্বার্থের ভিত্তিতে এই অঞ্চলে কূটনৈতিক ব্যস্ততা শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) আঞ্চলিক গ্রুপিংয়ের গুরুত্ব দেখিয়েছিল।

যাহোক, ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ান আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ায় এই ধারণাটি বাস্তবায়িত হতে প্রায় ২০ বছর সময় লেগেছিল।

উনিশ পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এবং উনিশ সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর আশপাশে সাধারণ উত্তর-ঔপনিবেশিক চ্যালেঞ্জগুলো এই অঞ্চলের দুটি বৃহত্তম দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে স্নায়ুযুদ্ধের পরাশক্তির সাথে হাত মেলাতে বাধ্য করে। পাকিস্তান মার্কিন সমর্থিত সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো) এবং সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশনে (এসইএটিও) যোগ দেয়।

ভারত ন্যামের সদস্য ছিল কিন্তু ইউএসএসআরের প্রতি আরও সমর্থন দেখাতে শুরু করে। এই সম্পর্কটি ১৯৭১ সালের ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।

উনিশ সত্তরের দশকের শেষের দিকে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে 'জরুরি অবস্থা' ঘোষণা করেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। তবে তাদের আঞ্চলিক নীতির প্রতিশ্রুতি ছিল। পাকিস্তান ১০৭৯ সালে ন্যামে যোগ দেয়। ভারত ধীরে ধীরে কোনো পরাশক্তির সাথে মিত্রতা না করার প্রাথমিক অবস্থানে ফিরে আসে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংলাপ অব্যাহত রাখে।

সার্ক কেন?

প্রায় ৪০ বছর ধরে, সার্ক, বিশেষ করে এর শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে, নীতি-উদ্যোগ ও সংলাপের জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোকে একত্রিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে এই শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে সংলাপ আরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৮ সালে ২৯-৩১ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে চতুর্থ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক সম্মেলনের মাত্রা নির্ধারণ করে। উভয় নেতা তাদের জনগণের মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের প্রচারের গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের জন্য বিশেষ ভ্রমণ চুক্তির জন্য সম্মত হন এবং ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন যা ১৯৯২ সালে চালু হয়। পরে সেখানে গবেষক ও শিক্ষাবিদরা অন্তভুক্ত হন। এতে দেশগুলোর মধ্যে উদ্যোগ ও বিনিময় বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু সেই বন্ধুত্ব ছিল স্বল্পস্থায়ী ছিল। ১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে, যার ফলে শত্রুতা দেখা দেয়। পরের বছর কার্গিল যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা আবার বেড়ে যায়। ১১তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন প্রায় চার বছর বিলম্বিত হয়েছিল। ২০০২ সালে যখন কাঠমান্ডুতে আবার শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হ্যান্ডশেকের ফলে দুই দেশের মধ্যে সংলাপ পুনরায় শুরু করতে সহায়তাক হয়।

সার্ক সভা থেকে উদ্ভূত অসংখ্য প্রকল্প ও উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা পর্যায়ক্রমে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সার্ক-সম্পর্কিত কার্যক্রমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। ২০১৬ সালে ভারত পাকিস্তানকে উরি হামলার জন্য অভিযুক্ত করে। ভারত দাবি করে, এই হামলায় বেশ কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। সে বছর ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকার করে ভারত। বাংলাদেশ, ভুটান ও আফগানিস্তানও পরে নিরাপত্তার অজুহাত দেখায়।

সার্কের মাধ্যমে প্রথম দিকে মতাদর্শগত বিভাজন পেরিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল। সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) ২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বার্ষিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। সার্ক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র বিপর্যয়ে সাড়া দেওয়ার হার বাড়িয়েছে, বিশেষ করে ২০০৪ সালে সুনামির সময়। সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র্য নিরসনের উন্নতিতে সাহায্য করেছে।

অথচ ২০১৪ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা এই নভেম্বর কোনো সম্মেলন ছাড়াই এক দশক পূর্ণ করবে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন বিভাগের মেট ইলস্ট্রুপ সাঙ্গিওভানি বলছেন, যেকোনো সংস্থা যদি ১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে কাজ না করে তবে আইনত মৃত বলে বিবেচিত হতে পারে।

এই গবেষক ১৮১৫ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৫৬১টি আন্তঃসরকারি সংস্থার উপর একটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে তার উপসংহারটি তুলে ধরেন। তিনি বলছেন, এমন জোটের মধ্যে ৩৪৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে সার্কেরও এমন পরিণতি হতে পারে।

(দ্য উয়্যার ডট ইন থেকে অনুবাদ)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন