যুক্তরাজ্যে নির্বাচন : কম ভোটেও লেবার পার্টির ভূমিধস জয় যেভাবে
লেবার পার্টি নেতাদের প্রচারণার একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাজ্যের সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে লেবার পার্টি ৬৫০ আসনের লড়াইয়ে ৪১২টি দখল করতে পেরেছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এত বড় জয় পেলেও তাদের ভোট শেয়ার বেড়েছে মাত্র ১.৬ শতাংশ। এই সামান্য পরিমাণ বর্ধিত ভোট পেয়েই তারা ২১১ টি আসন যোগ করতে পেরেছে। এত কম ভোট শেয়ার (৩৩.৭%) পেয়ে এতবেশি সংখ্যক আসন পাওয়ার ঘটনা ব্রিটেনের রাজনীতিতে আগে কখনো ঘটেনি। এই নির্বাচনে ভোটের হারও সর্বকালের সর্বনিম্ন হারের অন্যতম। সবমিলিয়ে এই নির্বাচনের ফলাফলের নানা দিক আলোচিত হচ্ছে রাজনীতি সচেতনদের মাঝে।
কিভাবে এটি সম্ভব হলো? মূলত লেবার পার্টির প্রতিপক্ষ তথা কনজারভেটিভ পার্টি তাদের নিজস্ব ভোটব্যাংক ধরে রাখতে না পারায় এটি সম্ভব হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টি গতবারের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। অন্যদিকে, কনজারভেটিভ পার্টিরই সাবেকদের গড়া নতুন দল 'রিফর্ম ইউকে' পেয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ ভোট। এটা হয়েছে কনজারভেটিভ পার্টির ভোটাররা বিভক্ত হওয়ার কারণেই। দলের উপর ক্ষোভ থেকে এই ভোট শিফট হয়েছে। একইসাথে যে ভোটাররা গত নির্বাচনে তাদেরকে ভোট দিয়েছিল তাদের অনেকেই এবার দেয়নি গত কয়েক বছরে সরকারের নানান ব্যর্থতার কারণে। এছাড়া তাদের সমর্থকদের একটি ছোট অংশ ভোট প্রদানেও বিরত ছিল। অর্থাৎ, নিজেদের ভোট সে অর্থে না বাড়লেও শুধু প্রতিপক্ষের ভোট বিভক্ত হওয়ায় এত বড় জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। নির্বাচন ছয় মাস এগিয়ে এনেও এই বিভক্তি ঠেকাতে পারেনি কনজারভেটিভরা।
তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই নির্বাচনকে বিরোধীদলের জেতার চেয়ে সরকারি দলের পরাজয়ের নির্বাচন বলছেন। বিরোধীদল লেবার পার্টি শুধু তার ভোটব্যাংক ধরে রাখার চেষ্টা করেছে এবং তাতেই তার ভূমিধস বিজয় সম্ভব হয়েছে। কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ‘ব্রিটিশ পলিটিক্স অ্যান্ড পাবলিক পলিসি’ বিভাগের শিক্ষক ড. টনি ম্যাকনাল্টি এই ভূমিধস জয়কে ‘Loveless Landslide’ বা ‘ভালোবাসাহীন ভূমিধস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, লেবারের যে ধরনের ভোটার ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তা ধরে রাখতেই তারা মনোযোগী ছিল এবং তা করতে গিয়ে কিছু জায়গায় ভোট হারিয়েছেও। প্রতিপক্ষের ভোট বিভক্তিকে মাথায় রেখেই যতটুকু হারালে ক্ষতি হবে না তা হিসাব করে ততটুকু হারানোর সুচারু কৌশল করে প্রত্যাশিত ফল পেয়েছে লেবার।
কনজারভেটিভদের ভোট বিভক্তি যে শুধু লেবারকে এতবড় জয় দিয়েছে তা নয়। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (লিবডেম) মাত্র ০.৬% ভোট শেয়ার বাড়িয়েও এবার যে ৬৩টি আসন যোগ করেছে সেটাও মূলত এসেছে কনজারভেটিভদের থেকে। প্রায় সব আসনেই লিবডেমের জয়ের ব্যবধান রিফর্ম ইউকে'র প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে কম ছিল। অর্থাৎ, পরিষ্কারভাবে কনজারভেটিভদের ভোট বিভক্তির ফল পেয়েছে লিবডেমও। লিবডেমের ভোটের ক্যাম্পেইনের ফোকাসও অবশ্য খুব কন্সেন্ট্রেটেড ছিল এই আসনগুলোতেই, যেহেতু আগেরবার তারা এগুলোতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। আরও কয়েকটি পয়েন্টে দেখা যাক এই নির্বাচনের ফলাফল -
ভোটার উপস্থিতি
নির্বাচনে একটি দলের ভূমিধস বিজয় সাধারণত বড় ভোটার উপস্থিতিকে ইঙ্গিত করে। বিশেষ করে বিরোধীদলের বড় বিজয়ে সেটাই হয়। ঐতিহ্যগতভাবেই এটা হয়ে আসছে। ভোটারের ব্যাপত সংখ্যায় ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অর্থ সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বুঝায়। আর কম ভোটার উপস্থিতির অর্থ সরকারে কোনো পরিবর্তন না আসা। অথচ যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচনে দেখা গেলো উল্টো চিত্র। এবারের নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ গতবারের চেয়ে ৭% কম এবং ১৯৪৫ সালের পর সবচেয়ে কম ভোটের নির্বাচনগুলোর একটি।
ভোটার উপস্থিতির জাতীয় গড় ৬০% হলেও অনেক এলাকায় ৪০% সামান্য ওপরে ভোট পড়েছে। এমনকি লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টার্মারের আসনেও ১২% ভোট কমেছে। অর্থাৎ খোদ হবু প্রধানমন্ত্রীর এলাকাতেও নির্বাচনী উত্তেজনা অনুপস্থিত ছিল। আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তিনি নিজেও গতবারের চেয়ে ১৫.৬% কম ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, এই নির্বাচনে লেবারের পক্ষে কোনো সমর্থনের ঢেউ ছিল না। পেন্ডুলাম লেবারের দিকে হেলেছিল বলে তার জয় ছিল অবধারিত। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল এবং তা যে লেবার পার্টিকে ভোট না দিয়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভব তা দেখিয়েছে।
তাই বলে এত কম ভোটার উপস্থিতিতে এতবড় জয়? বিভিন্ন জরিপসহ নানাভাবে মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল যে লেবার পার্টি পরিষ্কার মেজোরিটি পেতে যাচ্ছে। ফলে এধরনের 'পূর্বনির্ধারিত' ফলের ভোটে মানুষের আগ্রহ কম ছিল। একই মত ড. টনি ম্যাকনাল্টিরও। তার মতে, ভোটের ফলাফল 'ক্লিয়ার কাট' মনে হলে মানুষ কম আগ্রহী হয়ে থাকে, এই নির্বাচনেও তাই হয়েছে। ড. টনির কথার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় লেবার পার্টির আসনগুলোতেই। তাদের আগেরবারের জেতা আসনগুলোর ৭৫% এর ক্ষেত্রে ভোট পড়ার হার ছিল জাতীয় গড়ের চেয়ে অন্তত ৫% কম, অর্থাৎ গতবারের চেয়ে ১২% কম। তবে কনজারভেটিভদের আসনগুলোতে গতবারের চেয়ে মাত্র ৩% ভোট কম পড়েছে। অর্থাৎ ক্ষুব্ধ কনজারভেটিভ ভোটাররা তাদের নতুন বিকল্প রিফর্ম ইউকে'কে ভোট দিতে বের হয়েছিল।
ভোটিং ধরন
মোটাদাগে লেবার পার্টি তার ভোটব্যাংক ধরে রাখতে পেরেছে। তাদের যে ধরনের ভোটার ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তা ধরে রাখতে পেরেছে, এবং তা করতে গিয়ে কিছু জায়গায় ভোট হারিয়েছে। তবু জিতেছে। যেমন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা মুসলিম অধ্যুষিত আসনগুলোতে ভোটে হারালেও জিতেছে। অন্যদিকে, কনজারভেটিভদের ভোটব্যাংকের অন্তত ৩% ভোট দিতে বের হয়নি। বাকি ভোট ভাগ হয়েছে মূলত রিফর্ম ইউকে'র সাথে। ফলে প্রথমবারের মতো তাদের ভোট পাওয়ার হার ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে।
এছাড়া, ফলাফল অনুসারে শহরের ভোটাররা লেবারকে বেশি ভোট দিয়েছে। সুইং ও উদারপন্থীদের ভোট লেবারের পাশাপাশি গ্রিন পার্টিও পেয়েছে। মুসলমানদের অনেকে ফিলিস্তিনপন্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে।
বাংলাদেশি ও মুসলমানদের ভোটিং ধরন
বাংলাদেশিরা সাধারণত লেবার পার্টির ভোটব্যাংক হলেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে লেবার পার্টির পরিষ্কার অবস্থান না থাকা এবং শেষ মুহূর্তে কিয়ের স্টার্মারের বিতর্কিত বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে একটা বড় অংশ ফিলিস্তিনপন্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকে ভোট দিয়েছে। এর প্রভাব দেখা গেছে লেবারের ভোট শেয়ারে। লেবার জিতলেও তা পেরেছে খুব সামান্য ব্যবধানে। উদাহরণ হিসেবে লন্ডনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড স্টেপ্নি আসনের কথা বলা যায়। লেবারের রুশনারা আলী আবারো জিতেছে তবে তা মাত্র হাজার দেড়েক ভোটে। গতবারের তুলনায় ভোট কমেছে প্রায় ৪০%। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফিলিস্তিনপন্থী আজমল মাশরুর, তিনিও বাংলাদেশি অরিজিন।
অবশ্য ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেছে পাশের আসন পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজে বাংলাদেশি অরিজিন লেবারের প্রার্থী আপসানা বেগমের ক্ষেত্রে। আপসানা শুরু থেকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সংসদ ও সংসদের বাইরে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তার আসনে কেউ ফিলিস্তিনপন্থী হিসেবে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেনি। ফলে অনায়াসে জয় পেয়ে যান তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে ভোট শেয়ারের পার্থক্য ছিল প্রায় ২৯%। উল্লেখ্য, আপসানা বেগম ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম হিজাবী হিসেবে পরিচিত।
আপসানার এমন জয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার সম্পাদক শামসুল আলম লিটন বলেন, 'আপসানা গাজার যুদ্ধ বন্ধে পার্লামেন্টে প্রতিটি মোশনে সমর্থন দিয়েছেন এবং লন্ডনে নাগরিক সমাজের সমাবেশে সোচ্চার থেকেছেন। জেরেমি করভিনের সমর্থক হিসেবে তাকে ডি-সিলেক্ট করার দলীয় সিদ্ধান্ত লেবারের প্রধান ভিত্তি ইউনিয়নের সমর্থনে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হন। জাতীয়ভাবে লেবারকে প্রত্যাখ্যান করে কোথাও কোথাও ভোটদানে বিরত থাকলেও লেবারকে এই আসনে জেতাতে বাংলাদেশি ও মুসলিম ভোটারদের সরব দেখা যায়। যা ছিল ব্যক্তিক্রম।'
আপসানা বেগমের ব্যতিক্রম ছাড়া মুসলমানরাও মোটামুটি একইভাবে ভোট দিয়েছে। যেমন, ইলফোর্ড নর্থে লেবারের প্রার্থী জিতেছে মাত্র ৫২৮ ভোটে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফিলিস্তিনপন্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী। এখানে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনপন্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট দিয়েছে।
শামসুল আলম লিটন মনে করেন গাজা ইস্যুতে লেবারের অবস্থান ও তাদের নেতার দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য লেবারের কয়েকটি নিশ্চিত জেতার মতো আসনও হাতছাড়া হয়েছে। এর মধ্যে লেস্টার সাউথ আসনে সিনিয়র নেতা জোনাথন এশওয়ার্থ এর পরাজয় উল্লেখযোগ্য।
রিফর্ম ইউকে ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি
নতুন দল হলেও ১৪ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তাঁক লাগিয়েছে রিফর্ম ইউকে। মাত্র ৫টি আসনে জিতলেও ১০০টির বেশি আসনে দ্বিতীয় হয়েছে। তারা কনজারভেটিভদের ভোটে এতটাই ভাগ বসিয়েছে যে গত ১০০ বছরের তথ্য থেকে জানা যায় শতাংশের হিসাবে এবারই সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছে কনজারভেটিভরা। ভোট শেয়ারের বিচারে রিফর্ম এখন তৃতীয় বৃহত্তম দল। কনজারভেটিভ ও রিফর্মের যৌথ ভোটের সংখ্যা লেবারের চেয়ে ২.২ মিলিয়ন বেশি, যৌথ ভোট শেয়ার ৪.৩ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ, সাদা চোখে দেখলে আগামী দিনে এই দুই দল ভোট বিভক্ত করতে থাকলে লেবারকে ক্ষমতা থেকে হঠানো সম্ভব হবে না। আর জোটবদ্ধ হলে লেবারকে পরাজিত করা সহজ হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণ কি এতটা সহজ? আর রিফর্ম কি ভবিষ্যতে কনজারভেটিভদের ভোট আরও গ্রাস করবে? ড. টনি ম্যাকনাল্টি মনে করেন সেটির সম্ভাবনা কম। তার মতে, রিফর্ম কতটা থাকবে তা নির্ভর করছে কনজারভেটিভদের নিজেদের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার উপর। তার কথায়, রিফর্মের মতো দলগুলো জেতার পরে ভোগান্তিতে পড়ে, বিশেষ করে যখন তাদেরকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে হয়। এরা সাইডলাইনে থেকে সুন্দর সমাধানের টোপ দেখালেও তা বাস্তবতা বিবর্জিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, আগামী দিনের রাজনীতিতে মেরুকরণ হবে এবং তখন রিফর্মে চলে যাওয়া কনজারভেটিভদের ক্ষুব্ধ ভোটাররা ফিরে এসে তাদের জয়ী করবে। লেবার বনাম কনজারভেটিভ লড়াইয়ের পুরোনো আমেজ ফিরবে। অর্থাৎ, রিফর্মের এবারের ফলই হয়তো তাদের সবচেয়ে ভালো ফল, আগামী দিনে এর পুনরাবৃত্তি নাও হতে পারে।