তিন মাসে ১৪ লাশ : কুকি-চিনের সঙ্গে সমস্যা কোথায়, পরিণতি কী?
মুক্তাদির রশীদ
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ পিএম
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে গত তিন মাসে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ( কেএনএফ) এবং এর সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির ( কেএনএ) অন্তত ১৪ সমর্থক বা কর্মীর লাশ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকান্ড হয়েছে এপ্রিল মাসে বান্দরবানে ব্যাংক লুট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া ও সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলার খবরের পরে৷
এসব ঘটনার জন্যে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে কেএনএফ এবং এর সশস্ত্র সংগঠন কেএনএকেই দায়ী করা হয়েছে। এরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘু ৷ এসব আক্রমণের দায় কেএনএফ বা কেএনএ কখনও স্বীকার করেনি।
পার্বত্য এলাকায় এ নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে গত প্রায় তিন বছরের মধ্যে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কেএনএফ বা কেএনএর সঙ্গে সংঘর্ষে তা নতুন রূপ নেয় মাত্র।
সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে খুব একটা খোলামেলা কথা বলতে দেখা যায়নি। সেখানে হতাহতের পরিসংখ্যান নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। রাঙামাটি-বান্দরবানের সীমান্তবর্তী সেনা ছাউনিগুলোতে বেশ কয়েক দফা হামলার খবর পাওয়া গেছে। অতর্কিত হামলায় মারা গেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন নন কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিক। আহত হয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য। আর এসবের জন্য নিরাপত্তাসংস্থাগুলো দায়ী করেছে কুকি-চিনকে।
সরকারের পক্ষ থেকে কুকি-চিন নেতাদের সাথে দেশে এবং দেশের বাইরে নিরপেক্ষ স্থানে আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাও হয়েছে । তবে এপ্রিল মাসে অস্ত্রসহ ব্যাংক লুটের ঘটনার পর সরকার নড়ে চড়ে বসে।
কী হয়েছিলো তখন
২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো এক গোপন বার্তায় বান্দরবান পার্বত্য জেলা পুলিশ জানায়, রাত ৮টা ১৫ মিনিটে বান্দরবান জেলার রুমা থানাধীন বাজারস্ত সোনালী ব্যাংকে শতাধিক অস্ত্রসজ্জিত কুকি চিন সদস্যদের পোশাক পরিহিত সোনালী ব্যাংকের উত্তর দিক হতে ‘পূর্বপরিকল্পিতভাবে’ বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগ নিয়ে অতর্কিতভাবে হামলা করে অস্ত্রেরমুখে পুলিশ আনসার ও অন্যান্য লোকজনকে জিম্মি করে করে ফেলে। আক্রমণকালে সোনালী ব্যাংকে ডিউটিরত গার্ড কনস্টেবলসহ মোট ১০ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২ টি এসএমজি, ৬০ রাউন্ড বুলেট, ৮ টি চায়না রাইফেল ও ৩২০ রাউন্ড গুলি, আনসার সদস্যদের ৪ টি শট গান ও ৪৫ রাউন্ড কারতুজ এবং সোনালী ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা ও ব্যাংকের ম্যানেজার নিজামুদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। র্যাব পরবর্তীতে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে উদ্ধার করে।
ওই রাতেই রুমা পুলিশ ও সেনাবাহিনী লুটকৃত অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। অন্যদিকে ২ তারিখ রাতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মুজাহিদ উদ্দিন এক বার্তায় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে জানান, বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের সাব স্টেশন হতে উপজেলার বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে কুকি চিনের একশর বেশি সদস্য উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স কে এ সময় তারা উপজেলা মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের সকলের মোবাইল ও টাকা এবং সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যায়। পরে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে বাধ্য করে ভল্টের চাবি দনয়ে টাকা লুট করে।
ওই বার্তায় উল্লেখ করা হয়, কুকিচিনের সদস্যগণ করতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শেষ হওয়ার মাত্রই সাবস্টেশনটি পুনরায় চালু করা হয়। পরবর্তীতে শুরু হয় জয়েন্ট অপারেশন বা যৌথ অভিযান।
এ ঘটনার রেশ না যেতেই পরদিন একই রকম আক্রমণ চালানো হয় থানচিতে।
এর পরপরই সামরিক, বেসামরিক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ও গোয়েন্দা সংস্থাদের প্রধানদেরকে নিয়ে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ সেখান গিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি পর্যালোচনা করেন। কিন্তু তার পরপরই এক অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন সেনা সদস্য।
অভিযানের লক্ষ্য কী?
পুলিশ সদর দপ্তরের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) অপারেশন আনোয়ার হোসেন জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে যৌথ অভিযান চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, 'এত বড় ঘটনা ঘটার পর আসামি গ্রেফতার করা এবং ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারই প্রধান লক্ষ্য।'
ঘটনার পরপরই অনেক মামলা হয়েছে এবং সেসব মামলার তদন্তের প্রয়োজনে অভিযান প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন ।
তিন মাসে ১৪ লাশ
এপ্রিল মাসের ২ ও ৩ তারিখে ব্যাংক লুটের চেষ্টা চালায় কেএনএফ সদস্যরা। সরকার এমন ঘটনায় কেবলই বিব্রতই হয়নি, বরং কেএনফের সাথে চলমান শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়।
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বান্দরবানের সফরে যান এবং যৌথ অভিযানের কাজকে ত্বরান্বিত করেন। যৌথ অভিযানের বিষয়ে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে খুবই স্বল্প তথ্য সংগ্রহ করা গেছে।
এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এই যৌথ অভিযানে এখন পর্যন্ত পুলিশ ১৪টি লাশ পেয়েছে । পুলিশ বলছে, সংগ্রহ করা লাশগুলো কুকি সদস্য বা সমর্থকদের। উল্লেখিত সময়ে যৌথ অভিযান ও পুলিশ এখন পর্যন্ত ১১১ জনকে আটক করেছে।
পুলিশ বলছে, ১৪ টি লাশের মধ্যে ৬ টি পাওয়া গেছে রুমা থানা এলাকায়। আর রোয়াংছড়িতে ৫ টি, দুটি সদর থানায় এবং ১টি থানচিতে।
বাংলা আউটলুকের পক্ষ থেকে বান্দরবানই কর্মরত অন্তত তিনজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা হয়। এদের একজন জানান তাদের কাছে সন্দেহভাজন অজ্ঞাত গুলিবিদ্ধ লাশ এসেছে যাদের পরিচয় হিসেবে পুলিশ তেমন কিছু জানায়নি। এসব ঘটনায় অন্তত ২৪ টি মামলা হয়েছে। যার ১৪ টিই হয়েছে রুমা থানাতে।
মোট গ্রেফতারকৃত ১১১ জনের মধ্যে ৮৬ জন পুরুষ আর ২৫ জন নারী। এসব ঘটনায় ২৬ টি অস্ত্র উদ্ধারের দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পুলিশ বলছে, তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতার অব্যাহত আছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি কি ব্যর্থ?
ঘটনার কয়েকদিন পরেই ৭ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’র আহবায়ক ক্য শৈ হ্লা এবং এই কমিটির সদস্যসচিব লালজারলম বম এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৯ জুন ২০২৩ সকল সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর থেকে এই পর্যন্ত চারটি ভার্চুয়াল বৈঠক ও দুটি সংলাপ সফলভাবে সম্পন্ন হয়। সংলাপের উভয় পক্ষের মধ্যে প্রথম বৈঠকে চারটি এবং দ্বিতীয় বৈঠকে সাতটি স্বাক্ষর সম্পাদিত হয়। উভয় পক্ষের সম্মতি অনুযায়ী এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং সকলের পক্ষের সাথে যোগাযোগ চলছিল। ঠিক এমন সময় কেএনএফ কর্তৃক হামলা, লুট, অপহরণ সম্পূর্ণরূপে সমঝোতা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে আমরা মনে করি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি এখন পর্যন্ত রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার ৯৬৮ টি বম পরিবারের মধ্যে ১৩৪ টন খাদ্যশস্য, নগদ অর্থ, বস্ত্র, চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, কারান্তরীণ দুজনকে জামিনে মুক্তি লাভে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। অবশিষ্ট সদস্যদের মুক্তির ব্যাপারে আইন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত বম জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য এলাকার খাদ্যশস্য পৌঁছানো হয়ছে। তাদের উপস্থাপিত দাবি সমূহ ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট গোচারিভূত করা হয়েছে । আমরা অস্ত্র সমর্পণ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
কিন্তু তাদের এ আহ্বান তেমন কোন কাজে আসেনি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো কী করছে?
এপ্রিলের শেষ দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে দেশের ২০টি মানবাধিকার সংগঠনের জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের (এইচআরএফবি) একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে কেএনএফের 'সন্ত্রাসী' কাজের নিন্দা প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। কেএনএফের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে কোনো ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতিনিধিদল। এ বিষয়ে এইচআরএফবির পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে তারা উল্লেখ করেন, বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের দুটি শাখায় এবং কৃষি ব্যাংকের একটি শাখায় কেএনএফের সদস্য দলের নেতৃত্বে ব্যাংকে হামলা, টাকা লুট, রুমা শাখার ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ, ব্যাংকের সিকিউরিটির দায়িত্বে নিয়োজিত গার্ড, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ওপর আক্রমণ এবং আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে গত ৭ এপ্রিল থেকে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে। তারা লক্ষ্য করেছে যে, তল্লাশি পরিচালনাকালে নিরাপত্তাহীনতায় ও আতঙ্কিত হয়ে কুকি চিন জনগোষ্ঠীর অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিও বসতবাড়ি ছেড়ে বনভূমিতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এর ফলে তাদের জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অভিযোগ পাওয়া যায়, ৫ কেজির বেশি চাল কিনতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার এবং ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান এইচআরএফবির প্রতিনিধিদল।
প্রতিনিধিদলের উপস্থাপিত দাবীর প্রেক্ষপটে কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। সামগ্রিক বিবেচনায় যাতে পাহাড়ি এলাকার মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে সকলের প্রতি আহবান জানান তিনি।
কামাল উদ্দিন জানান, তারা নিবিড়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন।
অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পক্ষ থেকে বান্দরবানে কুকি চিনের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালে কী ধরনের মানবাধিকার অবস্থা সৃষ্টি করেছে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়।
সরকারের নড়েচড়ে বসা!
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বাংলা আউটলুককে বলেন, তিনি মনে করেন না যে, কুকি চিন গোষ্ঠীর এমন কার্যকর সামর্থ্য আছে যা থেকে তারা সেনাবাহিনী বা পুলিশের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
তিনি বলেন, কুকি চিন গোষ্ঠী এখন পর্যন্ত যেসব আক্রমণ চালিয়েছে তা থেকে বোঝা যায় তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে।
অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কাজ করছেন এমন একজন গবেষক বলেন, কেএনএফের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনার চেষ্টা যেন অব্যাহত থাকে।
কেএনএফ বা কেএনএ কী বলছে?
কেএনএফের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যোগাযোগ করা কষ্টকর হয়ে গেছে। অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন; আর দায়িত্বশীলরা সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থান করছে।
কেএনএ মুখপাত্র ক্যাপ্টেন ফ্লেমিং কয়েক মাস আগে জানান, তারা যে বৈষম্যের শিকার সেটাই তার তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
সেসময় তিনি বলেন, আমরা আসলে বৈষম্য বিলোপের চেষ্টা করছি। আমরা এদেশেই নাগরিক এবং চাই কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়। কিন্তু সরকার তো আমাদের যৌক্তিক দাবি দাওয়া মানছে না।
নাথান বম কি শান্তি চান?
নাথাম বমের বন্ধুদের একজন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বন্ধুদের সাথে তিন সেনাবাহিনী বিরোধী মনোভাব পোষণ করতেন। নাথাম পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীর সাথে অন্যান্য জাতি যে বৈষম্য তা নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিলেন। পরে তিনি সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। তিনি নির্বাচন করতে চান ২০১৮ সালে।
‘কিন্তু ২০১৮ নির্বাচনের পর তার সাথে সরকারের বিশেষত নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সম্পর্ক দুর্বল হতে থাকে,’ বলছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা । 'কেননা আমরা দেখছি ২০১৯ সাল থেকে তিনি সশস্ত্র সংগ্রাম চেষ্টা করছেন,' বলেন তিনি। তার মতে, তারা পার্শ্ববর্তী একটি দেশ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা যখন তল্লাশি জোরদার করি, তখন তিনি দেশ ছাড়েন। এটা ২০২২ শেষ দিকে হবে। তারপর থেকে তিনি মিজোরামে তার জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সাথে থাকতে শুরু করেন।'
একজন নিরাপত্তা গবেষক বলছিলেন, তিনি জেনেছেন ১৮ জনকে প্রাথমিক পর্যায়ে পাশ্ববর্তী দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তারপর এখন পর্যন্ত ২০০ শতাধিক সশস্ত্র সদস্য গড়ে তুলেছেন নাথান।
ওই গবেষক জানান, ভারত ও মিয়ানমারের কুকি জো সম্প্রদায়ের গুরুদের সাথে যোগাযোগ করে নাথানদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি, বরং বান্দরবানে সেনাবাহিনী ও তার স্থাপনায় আক্রমণ অব্যহত থেকেছে।
বমরা কি সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে?
নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত এমন সূত্রগুলো বলছে, নাথান বমের বয়স এখন ৪৩-৪৫ বছরের মধ্যে। তিনি যদি দীর্ঘমেয়াদে সশস্ত্র সংগ্রাম করেন, তাহলে তার জন্য যে অস্ত্র প্রয়োজন হবে, তা সংগ্রহ করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি তৈরি হবে। কিন্তু এতে বম এবং এদের সংশ্লিষ্ট ৭০০০ মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হুমকির মুখে ফেলবে। তাদের কৃষিকাজ কিংবা ব্যবসা, চাকুরি কিংবা শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উপমহাদেশে দীর্ঘমেয়াদে সফল হয়েছে, এমন নজির খুব একটা নেই।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন বলছেন, উপমহাদেশে দীর্ঘসময় কোন বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন টিকে থেকেছে এমন নজির কম। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রায় ২০ বছর সংগ্রাম অব্যহত রাখে, কিন্তু এর কস্ট ( ক্ষয়ক্ষতি) অনেক। এবং তা ভিন্ন দেশের সহোযোগিতা ছাড়া প্রায় অসম্ভব।
ভারত ও মিয়ানমারের ভূমিকা
গোয়েন্দা সংস্থার দুজন কর্মকর্তা বাংলা আউটলুক বলেন, তারা জানতে পেরেছেন, নাথান বম ও তার শীর্ষ নেতৃত্ব এখন ভারতের মিজোরামের রাজ্যের আইজলে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি কোথাও যাতায়াত করেন কিনা তার পুরো তথ্য তাদের আছে নেই।
অন্যদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আরাকান আর্মির অবস্থান শক্ত হওয়ায়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকিদের জন্যে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে কাজ করা দুরূহ। তাছাড়া মিজোরামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করে, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলে স্থলবেষ্টিত মিজোরাম দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
নতুন উদ্যোগ আর ভবিষ্যতের শঙ্কা
বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত সুত্রগুলো বলছে, পর্যদুস্ত হয়ে কেএনএফ বা কেএনএ এখন শান্তির কথা ভাবছে৷ তারা মনে করে, শান্তি ছাড়া এখানে অন্য কোনো উপায় কার্যকর নয়।
তবে এ তথ্য কেএনএফের কাছ থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
মেহেদী হাসান পলাশ গড়ে তুলেছেন সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন। তিনি এর চেয়ারম্যান। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, কুকি-চিনের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সমস্যা কি মিটবে?
পলাশ বাংলা আউটলুককে বলেন, প্রথমত কেএনএফ যেসব অস্ত্র লুট করেছে, সেগুলো যদি ফেরত দেয় এবং তারা যদি অস্ত্র ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক উপায়ে দাবিদাওয়ার জন্য আন্দোলন করে, এবং সরকার যদি তাদের যৌক্তিক ও সাংবিধানিক দাবিগুলো সহৃদয়ভাবে বিবেচনা করে, তাহলে এই সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগ পর্যন্ত বম জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই কেএনএফকে সমর্থন করতো। সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, বম জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কেএনএফ-এর বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছে, কেএনএফের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে যদি বম জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ থেকে কেএনএফ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে তারা টিকতে পারবে না।'
তিনি বলেন, প্রথমেই আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন কেএনএফ কেন সৃষ্টি হয়েছে? এর পেছনে আমি চারটি কারণ দেখি। প্রথমত, শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। কুকি- চীন ভুক্ত ছয়টি প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে ব্যাপক বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এই বৈষম্যের প্রতিবাদে তারা সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছে, যে কথাটি তারা বিভিন্ন সময় তাদের দাবি দেওয়ার মধ্যে উল্লেখ করেছে।
দ্বিতীয়ত, আমরা যদি শুধু উপরোক্ত কারণকে একমাত্র হিসেবে ধরে নিই, তাহলে বড় ভুল করব। কেননা আমরা একই সময়ে মিয়ানমারের কাচিন ও চীন রাজ্য এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সের বেশ কয়েকটি রাজ্যের কুকি-চীন জনগোষ্ঠী ভুক্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের অভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে দেখছি। অর্থাৎ তিনটি দেশের তিনটি সীমানার মধ্যে বিভক্ত হয়ে থাকা কুকি চীন জনগোষ্ঠী একটি অভিন্ন রাজনৈতিক কাঠামো ও অভিন্ন জাতি রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। এটি ইতিহাসে আলোচিত গ্রেটার কুকি ল্যান্ড চেতনা থেকে উৎসারিত কিনা গবেষণার দাবি রাখে। তবে আপাতত আমরা এটিকে রিভাইভ অব কুকি ন্যাশনালিজম বা কুকি জাতীয়তাবাদের পুনর্জন্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি।
তৃতীয়ত, আমরা উপরের আলোচ্য বিষয়টি যদি ভিন্ন আলোয় দেখার চেষ্টা করি, তাহলে দেখতে পাবো, তিন সীমান্তে বিভক্ত হয়ে থাকা এই কুকি চীন জনগোষ্ঠী প্রায় শতভাগ খ্রিস্টান। তাহলে এই বিষয়টিকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে, কুকি-চীনের নামে এই অঞ্চলের খ্রিস্টান সম্প্রদায় একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বা স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য সক্রিয় হয়েছে।
চতুর্থত, বৈশ্বিক বাণিজ্য, ভূ-রাজনীতি, যোগাযোগ, নিরাপত্তায় ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগরের ব্যাপক গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বিস্তারে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে যে নতুন নতুন প্রপঞ্চ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াকে ঘিরে পরাশক্তিগুলো নানা পরিকল্পনা, নকশা ও ধারণা নিয়ে হাজির হয়েছে।
মেহেদী হাসানকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কোন আশার আলো দেখছেন, নাকি আরও হত্যা ও সংঘর্ষ ঘটবে?
উত্তরে তিনি বলেন, অস্ত্র উদ্ধার না করতে পারলে এবং কেএনএফের মূল স্ট্রাকচার বা সিনিয়র কমান্ডারদের নিষ্ক্রিয় করতে না পারলে সংঘর্ষ ও হত্যাকান্ড থামানো কঠিন।
তিনি মনে করেন, যদি রোহিঙ্গা সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করা যায়; মিয়ারমারের রাখাইন ও কাচিন প্রদেশে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থানের একটি প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান নিশ্চিত না করা যায়; এবং তাদের কাছে থাকা বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র জব্দ না করা যায়, তাহলে এই অঞ্চলে শান্তির প্রত্যাশা মরীচিকা মাত্র।